কোন শব্দ, প্রবাদ বাক্য কিংবা বাগধারা তার প্রকৃত অর্থ হারায় নি
কুরআন মাজিদের একটি সমুজ্জ্বল ও অনন্য মুজিজা হল, তার ভাষা এখনও সজীব। এখনও কুরআন মাজিদ সেই একই ভাষায় পড়া ও বুঝা যায় যে ভাষায় তা আজ থেকে প্রায় সাড়ে চৌদ্দশ বছর পূর্বে অবতীর্ণ হয়েছিল। পরবর্তীতে সে যুগের মানুষের সকল ভাষাতেই পরিবর্তন এসেছে। একথা অনস্বীকার্য যে, একটি সময়ের পালাবদলে বহু শব্দ, বাগধারা ও প্রবাদ- প্রবচন অকেজো হয়ে যায়; শব্দের অর্থ ও তাদের বানানরীতিতে পরিবর্তন আসে এবং প্রত্যেক ভাষার শব্দ ভান্ডারে কিছু নতুন শব্দ সংযোজিত হয়। সর্বোপরি শব্দের ব্যবহার, প্রবাদ বাক্য এবং বাক্যের গঠনশৈলীতেও পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগে। কুরআন মাজিদের একটি জীবন্ত মুজিজা হল চৌদ্দশ বছরের অধিককাল পরেও এই আসমানি কিতাবের কোন শব্দ, প্রবাদ বাক্য কিংবা বাগধারা তার প্রকৃত অর্থ হারায় নি। যদিও আরবি ভাষা স্বাভাবিক গতি পরিবর্তন প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে পথ অতিক্রম করেছে, কুরআনের ভাষা তার সৌন্দর্য ও বাচনভঙ্গির মানদন্ডে এখনও সমহিমায় সমুজ্জ্বল।
উপরোল্লিখিত বা¯বার্তার নিরিখে দু’টি সাধারণ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা যেতে পারে। মানুষ কি এমন একটি সার্বজনীন ভাষা রচনা করতে সক্ষম, যা ১৪০০ (চৌদ্দশ) বছর পর্যন্ত মানুষের বোধগম্য থাকতে পারে? দ্বিতীয় প্রশ্নটি হল, মুহাম্মদ (সাঃ) এর মত একজন ব্যক্তি যিনি না জানেন পড়তে, না জানেন পড়তে, না জানেন নিজের নামটি পর্যন্ত লিখতে -কিভাবে তিনি এমন একটি শাশ্বত রচনাশৈলী উপস্থাপন করতে পারেন? উভয় প্রশ্নের উত্তরই খুব সুনিশ্চিত। এমন শাশ্বত ও চির সবুজ ভাষা না কোনো মানুষ লিখেছে, আর না কোনো মানুষ লিখতে সক্ষম? কেবলমাত্র সর্বশক্তিমান ও সর্বজ্ঞাত আল্লাহ তায়ালারই এ ধরনের চির সবুজ ও সর্বাঙ্গসুন্দর পরিপূর্ণ ভাষা রচনার শক্তি ও ক্ষমতা রয়েছে।
এই আলোচনার প্রেক্ষিতে উপসংহার টানা যায় যে, কুরআনের মতো একটি গ্রন্থ রচনা করা মুহাম্মদ (সাঃ) এর পক্ষে মানবীয়ভাবে সম্ভব ছিল না। কুরআন মাজিদের ভাষা এমন সব মিরাকল ও মুজিজা ধারণ করে যা বিচার বুদ্ধি ও যুক্তির নিরিখে ব্যাখ্যা করা যায় না। এসব মুজিজাই প্রমাণ করে যে, কুরআন মাজিদ সর্বজ্ঞাতা আল্লাহ্ তায়ালার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ আসমানি গ্রন্থ। আল্লাহ তাআলা তাঁর কিতাবে এমন সমুজ্জ্বল মুজিজাসমূহ এজন্য রেখেছেন যাতে মানুষ যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে এটিকে আসমানি হেদায়েত ও নির্দেশনা হিসেবে গ্রহণ করে এবং এটির নির্দেশনা অনুসারে নিজেদের জীবন গঠন করে।
কুরআন মাজিদে ইরশাদ করা হয়েছে,
قُلْ لَئِنِ اجْتَمَعَتِ الْإِنْسُ وَالْجِنُّ عَلَى أَنْ يَأْتُوا بِمِثْلِ هَذَا الْقُرْآَنِ لَا يَأْتُونَ بِمِثْلِهِ وَلَوْ كَانَ بَعْضُهُمْ لِبَعْضٍ ظَهِيرًا (88)
‘বলুন, যদি মানুষ ও জিন জাতি এ মর্মে একতাবদ্ধ হয় যে, তারা কুরআনের মত একটি গ্রন্থ (তৈরি করে) নিয়ে আসবে, তারা কিছুতেই তার মত রচনা করতে সক্ষম হবে না। এমনকি যদিও তারা (এ ব্যাপারে) পরস্পর পরস্পরের সহায়ক হয়।’ (বনি ইসরাইল, ১৭ : ৮৮)
هُوَ الَّذِي أَنْزَلَ عَلَيْكَ الْكِتَابَ مِنْهُ آَيَاتٌ مُحْكَمَاتٌ هُنَّ أُمُّ الْكِتَابِ وَأُخَرُ مُتَشَابِهَاتٌ فَأَمَّا الَّذِينَ فِي قُلُوبِهِمْ زَيْغٌ فَيَتَّبِعُونَ مَا تَشَابَهَ مِنْهُ ابْتِغَاءَ الْفِتْنَةِ وَابْتِغَاءَ تَأْوِيلِهِ وَمَا يَعْلَمُ تَأْوِيلَهُ إِلَّا اللَّهُ وَالرَّاسِخُونَ فِي الْعِلْمِ يَقُولُونَ آَمَنَّا بِهِ كُلٌّ مِنْ عِنْدِ رَبِّنَا وَمَا يَذَّكَّرُ إِلَّا أُولُو الْأَلْبَابِ (7)
তিনিই তোমার ওপর কিতাব নাজিল করেছেন, তার মধ্যে আছে মুহকাম আয়াতসমূহ। সেগুলো কিতাবের মূল, আর অন্যগুলো মুতাশাবিহ্। ফলে যাদের অন্তরে রয়েছে সত্যবিমুখ প্রবণতা, তারা ফিতনার উদ্দেশ্যে এবং ভুল ব্যাখ্যার অনুসন্ধানে মুতাশাবিহ্ আয়াতগুলোর পেছনে লেগে থাকে। অথচ আল্লাহ ছাড়া কেউ এর ব্যাখ্যা জানে না। আর যারা জ্ঞানে পরিপক্ক, তারা বলে, আমরা এগুলোর প্রতি ঈমান আনলাম, সবগুলো আমাদের রবের পক্ষ থেকে। আর বিবেক সম্পন্নরাই উপদেশ গ্রহণ করে। (আলে ইমরান, ০৩ :০৭)